বুধবার ৮ অক্টোবর ২০২৫ - ০৯:৫২
মুজতাহিদ তৈরি করাই হাওজায়ে ইলমিয়ার মূল দায়িত্ব

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশিষ্ট মারজায়ে তাকলিদ আয়াতুল্লাহিল উজমা জাওয়াদি আমুলি বলেছেন, “মুজতাহিদ তৈরি করাই হাওজায়ে ইলমিয়ার প্রধান ও মৌলিক দায়িত্ব।”

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলি বলেন, হাওজা বা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন মানুষ তৈরি করবে, যারা হবে মুজতাহিদ (যারা গভীরভাবে ইসলামি আইন ও চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করে রায় নির্ণয় করতে পারেন), সৃজনশীল, উদ্ভাবনী এবং গভীর চিন্তাশীল, যাতে আল্লাহর ওহীর (ঐশী বার্তা) ধারাবাহিকতা ও ইজতেহাদের পথ সমাজে অব্যাহত থাকে।

ওহীর সঙ্গে সম্পর্ক ও ইমামদের পথ
আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলি তাঁর দারসে খারিজে ফিকহে (উচ্চস্তরের ইসলামী ফিকহের ক্লাসে) বলেন, “যেসব ঐশী নেতা বা ইমাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের প্রথম পদক্ষেপই ছিল নিজেদের শিক্ষাগ্রহণ ও জ্ঞানের সম্পর্ক কেবল ওহির (আল্লাহর বাণীর) উৎসের সঙ্গে স্থাপন করা। তাঁরা ঘোষণা দেন যে, আমরা কখনোই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট রুজু (বা অন্যের দ্বারস্থ হওয়া) করিনি এবং করবও না; আমরা কেবল আল্লাহর কাছ থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করি।”

তিনি বলেন, এটি প্রকৃতপক্ষে ঐশী জ্ঞানের স্বাধীনতা ও মানবিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উভয়কেই প্রকাশ করে। ইমামগণ কোনো পার্থিব শিক্ষক বা মানবিক উৎস থেকে শিক্ষা নেননি; তাঁদের জ্ঞানের উৎস সরাসরি ওহি বা আল্লাহর শিক্ষা।

সত্য জ্ঞানের উৎস আহলে বাইত (আ.)
এই মহামান্য মারজায়ে তাকলিদ আরও বলেন, “যেখানেই তোমরা কোনো সঠিক ও নির্ভুল জ্ঞান পেয়েছ, জেনে রাখো, তার মূল উৎস আমরাই। আর যা আমাদের আহলে বাইতের কাছ থেকে নয়, তা সত্য নয়।”

ইমাম বাকের (আ.)-এর হাদীসের ব্যাখ্যা
তিনি হযরত ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত একটি বিখ্যাত হাদীস উদ্ধৃত করে বলেন,
کُلَّمَا لَمْ یَخْرُجْ مِنْ هَذَا الْبَیْتِ فَهُوَ بَاطِلٌ
অর্থাৎ, “যে বিষয় এই আহলে বাইতের ঘর (আমাদের পরিবার) থেকে বের হয়নি, তা বাতিল।”

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, এই বাক্যটির গভীর অর্থ হলো—আল্লাহর ধর্ম কেবল তিনিই ব্যাখ্যা করেন, এবং সেই ব্যাখ্যা তাঁর মনোনীত প্রতিনিধিদের (ইমামদের) মাধ্যমে মানবজাতির কাছে পৌঁছে।

ওহি ও ইজতেহাদের ধারাবাহিকতা
আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলি বলেন, ঐশী নেতারা তাঁদের শিষ্যদেরকে ইজতেহাদের (ধর্মীয় বিষয়সমূহে যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ) আহ্বান জানান এবং সেই পথ প্রদর্শন করেন। সেই পথের দিকনির্দেশনা বিভিন্ন নুসুসে (আল্লাহর ওহির বাণী ও হাদীসে) বিদ্যমান।

তাঁরা বলেন, “আমরা নবীর মুজিজা (অলৌকিক প্রমাণ), আমরা কারও ছাত্র নই।”

অর্থাৎ, তাঁদের জ্ঞান অর্জন মানবীয় সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা ঐশী উৎস থেকে প্রাপ্ত।

আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.) নবীর (সা.) মুজিজা
আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলি আরও বলেন, “যখন কিছু মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তোমরা কেন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছ? তারা বলল—আমরা আলী (আ.)-এর কারণে নবীর প্রতি ঈমান এনেছি, কারণ আলী নবীর মুজিজা।

আলী (আ.)-এর জীবন, জ্ঞান ও চরিত্রই নবীর সত্যতার জীবন্ত প্রমাণ। এমন এক মানুষ, যিনি কোনো পার্থিব শিক্ষকের কাছে অধ্যয়ন না করেও এমন এক জ্ঞানের স্তরে পৌঁছেছেন যে বলেন,
سَلُونِی قَبْلَ أَنْ تَفْقِدُونِی
অর্থাৎ, “আমাকে জিজ্ঞাসা করো, এর আগে যে তোমরা আমাকে হারিয়ে ফেলো।”

এটা কি সম্ভব, কোনো মানুষ কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষা না নিয়েই এমন এক স্তরে পৌঁছে যায়, যেখানে তিনি সর্বপ্রকার প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত? এটাই নবুওয়াত ও ইমামতের ঐশী জ্ঞানের প্রমাণ।”

ভুল ধারণার সংশোধন
আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলি বলেন, “যে ধারণা প্রচলিত আছে যে, ‘মানুষ কিছু বিষয় নিজের বুদ্ধিতে বুঝে, আর শরিয়ত পরে এসে সেটি অনুমোদন করে’—এটি ভুল ও অপরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “আসলে বিষয়টি তার বিপরীত। শরিয়তই প্রথমে ঐশী সত্য ঘোষণা করে, এরপর জ্ঞানবান মানুষরা তা অনুধাবন করে। পরবর্তী প্রজন্মগুলো তা তাঁদের কাছ থেকে গ্রহণ করে এবং সমাজে তা বিনায়ে উক্বালা (বুদ্ধিজীবীদের রীতি বা যৌক্তিক ভিত্তি) হিসেবে প্রকাশ পায়।”

তিনি আরও বলেন, “আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রথমে সৃষ্টি করেছেন পরিপূর্ণ মানুষকে (অর্থাৎ নবী ও ইমামদের), যিনি শিক্ষক। তারপর সৃষ্টি করেছেন শিক্ষার্থীকে (মানুষকে)।”

অর্থাৎ, জ্ঞানের উৎস মানব থেকে নয়; বরং মানব জ্ঞান ঐশী জ্ঞানের প্রতিফলন।

ইজতেহাদের প্রতিভা এক ঐশী দান

তিনি বলেন, “যার মধ্যে ইজতেহাদ, সৃষ্টিশীলতা ও নতুন চিন্তার যোগ্যতা রয়েছে, তা আল্লাহর এক বিশেষ দান। কিন্তু এই দান দায়িত্বও বটে।

সব মানুষের এই প্রতিভা থাকে না। তাই যে ব্যক্তি এই আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতা নিয়ে হাওজা বা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সাধারণ পেশা বা কাজের দিকে চলে যায়, সে এই ঐশী দানের প্রতি দায়বদ্ধ। সে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করবে।”

এই বক্তব্য দ্বারা তিনি ইঙ্গিত করেছেন যে, বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা ও ধর্মীয় প্রতিভা সামাজিক সম্পদ, যা নষ্ট করা উচিত নয়; বরং তা মানবতার সেবায় কাজে লাগাতে হবে।

আহলে বাইত (আ.)-এর নির্দেশনা ও হাওজার দায়িত্ব
আয়াতুল্লাহ জাওয়াদি আমুলি বলেন, আহলে বাইত (আ.) ইরশাদ করেছেন—
عَلَینا إلقاءُ الأصول و عَلَیکم التّفریع
অর্থাৎ, “আমাদের দায়িত্ব হলো মূলনীতি (উসূল) শিক্ষা দেওয়া, আর তোমাদের দায়িত্ব হলো সেই মূলনীতি থেকে শাখাগুলো (ফুরু’) নির্ণয় করা।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, এর মানে হলো, আহলে বাইত আমাদের সামনে ইসলামি জ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এখন হাওজা ও ইসলামি বিদ্বানদের কাজ হলো সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন নতুন বিষয়ের ইজতেহাদি বিশ্লেষণ করা, যাতে ইসলামী আইন ও চিন্তাধারা যুগোপযোগী থাকে।

তিনি বলেন, “তাহলে ছাত্রদের কাজ কেবল ফতোয়া মুখস্থ করা নয়, বরং এমন স্তরে পৌঁছানো যেখানে তারা নিজেরা ইজতেহাদ করতে সক্ষম হবে।”

হাওজার প্রধান দায়িত্ব ও মুজতাহিদ তৈরির গুরুত্ব
শেষে আয়াতুল্লাহুল উজমা জাওয়াদি আমুলি জোর দিয়ে বলেন, “মুজতাহিদ তৈরি করাই হাওজায়ে ইলমিয়ার মূল ও সর্বোচ্চ দায়িত্ব। হাওজাকে এমন মানুষ গড়ে তুলতে হবে, যারা হবে মুজতাহিদ, সৃজনশীল, উদ্ভাবনী ও যুগ-সচেতন। কেননা এই ধরনের মানুষই সমাজে ওহি ও ইজতেহাদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম।”

তিনি আরও বলেন, “যখন হাওযা প্রকৃত মুজতাহিদ তৈরি করবে, তখনই ইসলামী সমাজ চিন্তা, নীতি ও আইনগতভাবে জীবন্ত থাকবে; অন্যথায় তা নিছক মুখস্থবিদ্যা ও ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha